দুর্ভাগ্যক্রমে, “মগজখেকো অ্যামিবা” নামে বেশ পরিচিত ‘নেগলেরিয়া ফাওলেরি’ আবারও খবরে এলো। দুঃখের বিষয়, সর্বশেষ ঘটনাটি একটি ৬ বছর বয়সী ছেলে শিশু যে এই ধ্বংসাত্মক অ্যামিবার সংক্রমণে মারা গিয়েছি্লো । এই এককোষী জীব নেগলেরিয়া ফাওলেরি মস্তিষ্কে অলফ্যাক্টরি স্নায়ুতে(এটি ঘ্রাণবাহী সংবেদী স্নায়ুতন্ত্র) ভ্রমণ করে, যেখানে এটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং মস্তিষ্কের টিস্যু ভক্ষন করা শুরু করে। ৯৭% ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক রুপ নেয় । ইহা এখনও অত্যন্ত বিরল রোগ তবে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ, কারণ সংক্রমণ সর্বদাই মারাত্মক।
‘নেগলেরিয়া ফাওলেরি’ একটি এককোষী জীব যা মিঠা পানিতে বাস করে এবং এটি উষ্ণ পানিতে বাস করতে পছন্দ করে। ৪২ ডিগ্রি সেন্ট্রিগ্রেড (~১০৭ডিগ্রি ফারেনহাইট) তাপমাত্রায় দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায় তবে প্রায় ২৫ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা তার চেয়ে বেশি তাপমাত্রা অ্যামিবার বংশবৃদ্ধির করার জন্য যথেষ্ট। এ কারণেই বেশিরভাগ ঘটনা ফ্লোরিডা এবং টেক্সাসে শনাক্ত করা হয়েছে এবং এমন উদ্বেগ রয়েছে যে ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তন এই ধরনের অ্যামিবার পরিধি সম্প্রসারণে সহায়তা করতে পারে। জুলাইতে এই অ্যামিবার আক্রমণ এড়ানোর জন্য ফ্লোরিডার বাসিন্দাদের নাকের ক্লিপ দিয়ে সাঁতার কাটতে এবং নলের জলের সাথে সরাসরি যোগাযোগ এড়ানোর কথা বলা হয়েছিলো। এখন, টেক্সাসের কর্মকর্তারা একটি ৬ বছরের ছেলের মৃত্যুর পরে ৮ টি শহরে জল সরবরাহের লাইন পরীক্ষা করেছে। জ্যাকসন লেকের পাশে ৬ বছর বয়সী এই ছেলে শিশুর বাড়ির পানিতে এই মগজখেকো অ্যামিবার সন্ধ্যান পাওয়ার পর থেকে এই ব্যাপারে অনুসন্ধান করছে গবেষণা দল।

সেপ্টেম্বরে ৬ বছরের ছেলে শিশুটির মৃত্যুর জন্য এই অ্যামিবা দায়ী তা জানার পরে টেক্সাসের শহরটিতে পানি সরবরাহ বন্ধ করেছে এবং এটি স্বাভাবিক হতে কয়েক মাস সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। জ্যাকসন লেকের কর্তৃপক্ষরা জানিয়েছে যে শহরটিতে যে পানি বিষয়ক যে পরামর্শ রয়েছে তার অধীনে আরও তিন সপ্তাহ অবধি চলতে পারে। মারাত্মক জীবাণুটিকে ধ্বংস করার জন্য ক্লোরিনের পরিমাণ বাড়ানো হবে, এতে অতিরিক্ত ৬০ দিন সময় লাগতে পারে। সংক্রমণগুলি যুক্তরাষ্ট্রে তুলনামূলকভাবে বিরল ছিল (সিডিসি এর তথ্য অনুসারে ৬০ এর দশক থেকে ১৪৫ টি আক্রমণ রেকর্ড করেছে), তবে কিছু বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে উত্তর গোলার্ধের তাপমাত্রা বাড়ার কারনে এই জলঘাতী পরজীবী বৃদ্ধি সাধারণ হয়ে উঠেছে। মিনেসোটাতে দুজন শিশু ২০১০ এবং ২০১২ সালে নেগলেরিয়া ফাওলেরি নামক এই অ্যামিবার আক্রমণে মারা গিয়েছিলেন – উভয় ঘটনাই আমেরিকার উত্তর-পূর্বের ৫৫০ মাইল উত্তরে ঘটেছিলো। সিডিসি’র মহামারী বিশেষজ্ঞ জোনাথন ইয়োডার বলেছেন, “প্রথম কয়েক দশক ধরে আমরা এটি শনাক্ত করছি, এবং আমরা কেবল মার্কিন দক্ষিণাঞ্চলেই এই জীবের অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছি”, “তবে গত দশ বছরে আমরা অতিরিক্ত উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে, যেমন ইন্ডিয়ানা, মিনেসোটা, মিসৌরিতে এই মরনঘাতী পরজীবী শনাক্ত করেছি, যেখানে এর আগে আমরা এরকম ঘটনা লক্ষ্য করি নি।”
নেগলেরিয়া ফাওলেরি গলাধঃকরণ ক্ষতিকারক নয় , তবে শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে গ্রহণ করা মারাত্মক।
১৯৭০ সাল থেকে, যখন অস্ট্রেলিয়ান গবেষকরা এই মগজখেকো অ্যামিবাটিকে একটি নাম দিয়েছিলেন, তখন থেকেই নেগলেরিয়া ফাওলেরির কারণে মৃত্যুর খবরগুলো প্রতি গ্রীষ্মে প্রায়শই প্রকাশিত হয়েছে। নেগলেরিয়া ফাওলেরি অ্যারিজোনার মতো রাজ্যের উষ্ণ মিষ্টি জলে বসবাস করে, যেখানে এটি হ্রদ এবং নদীতে পাওয়া ব্যাকটেরিয়াগুলোকে খেয়ে বেঁচে থাকে। এটি একটি “মুক্তবাসী অ্যামিবা” হিসাবে পরিচিত, যার কোনো সঙ্গীর প্রয়োজন হয় না। মানুষ যদি দুর্ঘটনাক্রমে অ্যামিবা গলাধঃকরণ করে তবে তা ক্ষতিকারক নয়। তবে এটি যদি অনুনাসিক গহ্বরের ভিতরে চলে যায় তখন তা মারাত্মক হয়ে ওঠে। মাইক্রোস্কোপিক এই অ্যামিবা মস্তিষ্কে পৌঁছে কোনো খাদ্য উৎস খুঁজতে অনুনাসিক গহ্বরটি ভ্রমণ করে। একবার এটি মস্তিষ্কের টিস্যুতে খাওয়া শুরু করলে দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থা শ্বেত রক্তকণিকা যুদ্ধের জন্য পাঠায়, ফলে মস্তিষ্ক ফুলে গিয়ে একটি মারাত্নক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তি এক সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুবরণ করে।

লক্ষণগুলি মেনিনজাইটিসের অনুরূপ, তাই রোগীর পক্ষে ভুল রোগ নির্ণয় করা এবং ভুল চিকিৎসা গ্রহণ করার সম্ভাবনা থেকে যায়।
এই রোগ ম্যানিনজাইটিসের অনুরুপ হওয়ায় চিকিৎসকরা এটিকে মেনিনজাইটিস ভাবে এবং রোগী মেনিনজাইটিসের চিকিৎসার জন্য দুই তিন দিন সময় নেয় এবং তারপর যখন বুঝতে পারেন যে এটি কাজ করছে না ফলে তখন অনেক দেরি যায় কারণ ততক্ষনে অ্যামিবাটি মগজকে ভক্ষন করে ফেলে। ২০১৩ সালে দুটি শিশু এই পরজীবীটির আক্রমণ থেকে বেঁচে ফিরে, কারণ তাদের স্তন ক্যান্সারের ড্রাগ মিলটফোজিন দিয়ে দ্রুত চিকিৎসা করা হয়েছিলো। একজন ১২-বছর-বয়সী মেয়ে, মোটামুটি সুস্থ হয়ে ফিরলেও, কিন্তু আট বছর বয়সী ছেলেটি ব্রেইন ডেমেজের শিকার হয়েছিলো।
রেকর্ডের চেয়েও বেশি ঘটনা থাকার সম্ভাবনা রয়েই যায়ঃ
বিশেষজ্ঞরা অনুমান করেন যে প্রতি বছর ৩ থেকে ৮ জন আমেরিকান মারা যায় নেগলেরিয়া ফাওলেরিতে আক্রান্ত হয়ে। এই ভুক্তভোগীরা সাধারণত তরুণ এবং পুরুষ হয়, বিশেষ করে যারা উষ্ণ হ্রদে ঝাপাঝাপি করে। এর চেয়ে বেশি ঘটনা রয়েছে বলে জানা গেছে। যেহেতু এই রোগ ম্যানিনজাইটিস এর অনুরুপ তাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ডাক্তাররা এই রোগ নির্ণয় করতে ব্যর্থ হয়। ২০১৮ সালে, সিডিসি বাচ্চাদের অটোপ্সির ডেটা পরীক্ষা করে এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তারা অনুমান করেছিলেন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৬ টি শিশু বাৎসরিক নেগলেরিয়া ফাওলেরি দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা হয় – যা অফিসিয়ালদের পরিসংখ্যানের তুলনায় দ্বিগুণ।
“আমাদের বেশিরভাগ সময় সিডিসির সাথে বিতর্ক হয়, কারণ সিডিসি সর্বদা বলছে এটি একটি বিরল রোগ, মানুষকে ভয় দেখাতে হবে না,” হেগি বলেন। ” কিন্তু মূলকথা হলো এটি বিরল নয়। এই অ্যামিবা সারা পৃথিবীর মাটির প্রোফাইলগুলিতে পাওয়া যায় এবং এটি প্রাকৃতিকভাবে জন্ম নেয়।”

মার্কিন জল দিন দিন গরম হচ্ছে, এবং এটি অ্যামিবার জন্য সুসংবাদ হলেও মানুষের জন্য মারাত্মক ভীতির কারণ।
বিশেষ করে, গ্রীষ্মকালে দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে নেগলেরিয়া ফাওলেরির সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। অ্যামিবা উষ্ণ জায়গায় থাকতে পছন্দকরে এবং ১১৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় সমৃদ্ধতা লাভ করে। কিন্তু বিশ্ব উষ্ণায়িত হওয়ার সাথে সাথে জলের তাপমাত্রাও বাড়তে থাকে ফলে স্বাদুপানির উপস্থিতি তুলনামূলক বেশি লক্ষ্য করা যায়, যা নেগলেরিয়া ফাওলেরিকে আরো বৃহত্তরভাবে ভাবে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। এটি বিশ্বব্যাপী উদ্বেগের বিষয়- ২০১২ সালে পাকিস্তানে একজন নেগলেরিয়া ফাওলেরির আক্রমণে মারা গিয়েছিলেন। এমন কি ২০২০ সালে কোস্টা রিকার মধ্যেও দুইজন মারা গিয়েছিলেন । কোস্টা রিকার মত আমেরিকার এমন অনেক অংশ রয়েছে যেসব আগে এতো উত্তপ্ত হতো না। অ্যারিজোনার মতো দক্ষিণ রাজ্যে, গ্রীষ্মের সাধারণ তাপমাত্রা ৯০° ফারেনহাইট থেকে ১২০° ফারেনহাইট এর মধ্যে থাকে, যা নেগলেরিয়া ফাওলেরির জন্য উপযুক্ত। নিউ ইয়র্কের মতো রাজ্যে, সাধারণত গ্রীষ্মের তাপমাত্রা ৭০° ফারেনহাইট থেকে ৮৫° ফারেনহাইট অবধি থাকে, তবে তা পরিবর্তন হয়।
ইয়োডার বলেন, “উত্তরাঞ্চলের রাজ্যগুলিতে জলের উষ্ণতা বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে উদ্বেগের বিষয় এই যে, যারা এই রাজ্যগুলোতে পানির সংস্পর্শে যান তাদের পক্ষে ঝুঁকি বেশি হতে পারে,”
এই ধরনের অ্যামিবা কেবল হ্রদে বাস করে না। ২০০২ সালে অ্যারিজোনা এক মহিলা কিডি পুলে দূষিত গরম জল দিয়ে ভরাট করেছিলেন, ফলে অজান্তেই তার মেয়েকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। তারপর লুইসিয়ানার জলেও এই ভয়ানক অ্যামিবা শনাক্ত করা হয়। এতে আক্রান্ত হয়ে কমপক্ষে দু’জন মারা যায়। ভুক্তভোগীদের মধ্যে একজন ছিলেন চার বছর বয়সী ছেলে, যে বাড়ির উঠোনের স্লিপ-এন-স্লাইড খেলার সময় নাক দিয়ে পানি ঢুকেছিলো। অপর একজন তার বাড়ির ট্যাপের জল ব্যবহার করেছিলেন।
আমেরিকানদের ধরে নেওয়া উচিত যে উষ্ণ মিঠা পানিতেই অ্যামিবা রয়েছে। সে অনুসারে সতর্কতা অবলম্বন করা উচিত।
পানিতে নেগলেরিয়া ফাওলেরি শনাক্ত করার জন্য কোনো স্ট্যান্ডার্ড পরীক্ষা নেই, তাই সিডিসি পরামর্শ দিয়েছে যে “পানি ব্যবহারকারীরা ধরে নেওয়া উচিত যে নেগলেরিয়া ফাওলেরি যুক্তরাষ্ট্রের উষ্ণ মিষ্টি পানিতে উপস্থিত রয়েছে।” ইয়োডার বলেছেন, সিডিসি স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে নিরাপদ সাঁতার সম্পর্কে বার্তা সবার নিকট পৌঁছানোর জন্য কাজ করছে, এবং নেগলেরিয়া ফাওলেরি সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য চিকিৎসকদের সাথে কাজ করছে যাতে রোগীরা যখন লক্ষণগুলি দেখায় তারা এটি বিবেচনা করে। ইয়োডার পরামর্শ দিয়েছেন হ্রদে সাঁতার কাটার সময় লোকেরা পানির নীচে ডুব দেয়া এড়াতে এবং নাকে যেন প্লাগ পরিধান করা হয়।
তথ্যসূত্রঃ ইনসাইডার, সাইন্স এলার্ট।